আজকাল ওয়েবডেস্ক:দেশের নানা প্রান্তে এখনো প্রচলিত একটি বিশ্বাস হলো—সাপুড়ে সাপের দাঁত ভেঙে তার বিষ বের করে দেয়। ফলে সাপের কামড় আর বিপজ্জনক থাকে না। কিন্তু বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধারণা শুধু ভুল নয়, প্রাণঘাতীও হতে পারে। পাশাপাশি সাপকে এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

 

প্রচলিত মিথ ও আসল সত্য

 

অনেকেই মনে করেন, সাপুড়ে ধরা সাপের দাঁত ভেঙে দেয়, যাতে সাপ আর বিষ প্রবেশ করাতে না পারে। সাপুড়েদের মুখেও এই দাবি শোনা যায়। কিন্তু বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞ মৃদুল বৈভব, যিনি বহু বছর ধরে সাপ উদ্ধার ও সংরক্ষণ কাজের সঙ্গে যুক্ত, স্পষ্ট জানাচ্ছেন—এ ধারণা ভিত্তিহীন।

 

“সাপের দাঁত ভেঙে বিষ শেষ হয় না,” বলেন বৈভব। “দাঁত ভাঙলেও সপ্তাহের মধ্যে নতুন দাঁত গজিয়ে যায়। একবার আমি জয়পুরে একটি ঘটনা দেখেছিলাম—এক অপটু সাপুড়ে এক যুবককে ভাইপার বিক্রি করেছিল, বলেছিল দাঁত ভাঙা, তাই বিপদ নেই। কিন্তু সপ্তাহের মধ্যে নতুন বিষদাঁত গজিয়ে যায়, আর তার কামড়ে সেই যুবক মারা যায়।”

 

সাপের দাঁতের গঠন ও কাজ

 

বিষধর সাপের মুখে সাধারণত ২–৪টি লম্বা, বাঁকানো ও ফাঁপা দাঁত থাকে, যা বিষগ্রন্থির সঙ্গে যুক্ত। কামড়ের সময় এই ফাঁপা দাঁতের মাধ্যমে বিষ শিকারের শরীরে প্রবেশ করে। বিষহীন সাপের মুখে ইংরেজি অক্ষর ‘U’-এর মতো দাঁতের সারি থাকে, তবে তাদের বিষদাঁত থাকে না।

 

সাপের বিষ আসলে এক ধরনের পরিবর্তিত লালা, যাতে প্রোটিন ও এনজাইম থাকে। এর কাজ শিকারকে অবশ করা বা মেরে ফেলা এবং হজম সহজ করা। সাপের দাঁতের আরও কাজ আছে—শিকার ধরা, ধরে রাখা ও খাবার গিলতে সাহায্য করা।

 

দাঁত বদলানোর প্রক্রিয়া

 

সাপ নিয়মিত দাঁত বদলায়, বিষদাঁতসহ। পুরোনো দাঁত শিকার ধরতে গিয়ে বা আত্মরক্ষার সময় ভেঙে যেতে পারে। ‘অডোন্টোক্লাস্ট’ নামের বিশেষ কোষ পুরোনো দাঁত ভেতর থেকে ভেঙে দেয়। কখনো পুরোনো দাঁত পড়ার আগেই নতুন দাঁত তৈরি হয়ে যায়—ফলে একসঙ্গে তিনটি দাঁতও থাকতে পারে।

 

সাপুড়ের আসল কৌশল

 

মৃদুল বৈভব জানান, দাঁত ভেঙে নয়, সাপুড়েরা অনেক সময় বিষগ্রন্থি নষ্ট করে দেয়। এজন্য তারা সাপের মুখে লম্বা সূঁচ বা গরম ছাই ঢুকিয়ে গ্রন্থি ভেঙে দেয়, যাতে সাপে আর বিষ তৈরি না হয়। এরপর তারা সাপকে ডিমের মিশ্রণ খাওয়ায়। এই প্রক্রিয়া অবৈধ এবং সাপের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

 

আইন কী বলে

 

ভারতের বন্যপ্রাণ (সংরক্ষণ) আইন, ১৯৭২ অনুযায়ী—

 

সাপসহ সব প্রজাতির বন্যপ্রাণ সুরক্ষিত।

 

অবৈধভাবে শিকার, ধরা, হত্যা, বা ক্ষতি করা অপরাধ।

 

অপরাধ প্রমাণিত হলে জরিমানা ও কারাদণ্ড হতে পারে।

 

আইনটির ধারা ৯ অনুসারে, বন্যপ্রাণী ধরা বা ধরার চেষ্টা করাও দণ্ডনীয়।

 

 

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, সাপকে ইচ্ছাকৃত আঘাত, হত্যা বা বিষগ্রন্থি ধ্বংস করাও আইনের আওতায় অপরাধ। অপরাধের মাত্রা ও প্রজাতি অনুযায়ী শাস্তি ভিন্ন হতে পারে।

 

পরিবেশগত গুরুত্ব

 

বিশেষজ্ঞরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সাপ পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা ইঁদুর ও অন্যান্য পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করে, যা কৃষিজমি ও মানুষের বাসস্থানের জন্য উপকারী। তাই সাপ দেখলে হত্যা না করে স্থানীয় বন দপ্তর বা অনুমোদিত বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত।

 

মৃদুল বৈভবের সতর্কবার্তা:

“সাপের দাঁত ভেঙে নিরাপদ মনে করা ভয়ঙ্কর ভুল। এটি যেমন প্রাণঘাতী, তেমনই আইনি ঝুঁকিও রয়েছে। সচেতন হোন, সাপ বাঁচান, পরিবেশ বাঁচান।”