কৃশানু মজুমদার: বল নিয়ে তিনি যখন দৌড় শুরু করতেন, সতীর্থরা বলতেন, গতি তুলেছে 'রাজধানী এক্সপ্রেস'। 'ভারতের মারাদোনা' কৃশানু দে-র স্মৃতিতে এখনও তিনি ডুব দেন। নিজের মনেই বলতে থাকেন, ''কৃশানু যেরকম ভাল প্লেয়ার ছিল, সেরকমই বড় মনের মানুষ ছিল।'' স্বগোতোক্তির মতো শোনায় তাঁর কথা।
তাঁর বিচারে অমল দত্তই সেরা। পিকে ব্যানার্জি প্রসঙ্গে মতামত, ''একজন প্লেয়ারের ভিতর থেকে আসল খেলা বের করে আনতেন।''
তিনি সমীর চৌধুরী। তিন প্রধানের জার্সিতে ঘাম ঝরিয়েছেন। জাতীয় দলের প্রাক্তন ফুটবলারও বটে। তাঁর আরও একটা পরিচয়ও রয়েছে। ইস্টবেঙ্গল গোলকিপার দেবজিৎ মজুমদারের শ্বশুরমশাই। শিল্ড ফাইনালের পর থেকেই ইস্টবেঙ্গলে গৃহদাহ। কোচ অস্কার ব্রুজোঁর সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরে গোলকিপিং কোচ সন্দীপ নন্দী ইস্তফা দিয়ে গোয়া থেকে কলকাতা ফিরে এসেছেন।

ভিতরের কথা বেরিয়ে এসেছে সামনে। শিল্ড ফাইনালে টাইব্রেকারের ঠিক আগে সন্দীপ ও অস্কারের কথোপকথন এসে গিয়েছে প্রকাশ্যে। সন্দীপের অভিযোগ সেদিন টাইব্রেকারের আগের মুহূর্তে স্প্যানিশ কোচ অস্কার চাপে ফেলে দিয়েছিলেন দেবজিৎকে। সর্বসমক্ষে অস্কার জিজ্ঞাসা করে বসেন, ''দেবজিৎ, তুমি সবার সামনে বলো ইস্টবেঙ্গলকে টাইব্রেকারে জেতাতে পারবে?''
পেনাল্টি স্পট থেকে গোললাইন পৃথিবীর রহস্যময় সরণী। এই সরণীতে পরীক্ষা দিতে হয় গোলকিপারকে। পরীক্ষায় বসতে হয় যে শট মারছে তাঁকেও। শিল্ড ফাইনালের সেই অধ্যায় নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হয়েছিল পাঁচ বার সন্তোষ ট্রফি খেলা সমীর চোধুরীর কাছে। টাইমমেশিনের সাহায্য না নিয়ে তিনি ফিরে যাচ্ছেন পঁচাশি সালের সেই বিখ্যাত ইস্টবেঙ্গল-মহমেডান স্পোর্টিং ম্যাচে।
কৃশানু দে-কে প্রথম একাদশে রাখেননি পিকে। দ্বিতীয়ার্ধে কৃশানুকে যখন মাঠে পাঠাচ্ছেন প্রদীপ ব্যানার্জি, তখন ইস্টবেঙ্গল পিছিয়ে। তার পরের ঘটনা ইতিহাস। কৃশানু দে একাই মাটি ধরিয়ে দেন সাদা-কালো ব্রিগেডকে। সমীরবাবু বলছেন, ''এটাই পিকে ব্যানার্জি। কৃশানুর ভিতরের রাগটা বের করে আনতে পেরেছিলেন সেদিন। নামার আগে বলেছিলেন, দেখিয়ে দাও তুমি কৃশানু দে। সবার থেকে আলাদা। কোচ হবেন এরকম। অস্কার কিন্তু উল্টো পথে হাঁটলেন। দেবজিৎকে প্রশ্ন করে ওর উপরে মানসিক চাপ বাড়িয়ে দিলেন। আমি এটা পছন্দ করিনি। বলতে পারেন আমার ভাল লাগেনি।''

তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার পরিপূর্ণ। বহু দেখেছেন তিনি। সমীর চৌধুরী বলছেন, ''দেবজিৎ আমার জামাই বলে বলছি না। ও খুব ভাল গোলকিপার। প্রভসুখান গিলের কিপিং আমার ভাল লাগে না। অনেকবার দলকে বিপদে ফেলেছে। আমিই জানতে চেয়েছিলাম, দেবজিৎকে কেন খেলানো হচ্ছে না। তবে এটাও ঠিক শিল্ড ফাইনালে গিল ভাল কিপিং করছিল। ও যখন ভাল খেলছিল তখন তোলার দরকারই ছিল না। আবার দেবজিৎকে যখন মাঠে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, তখন ওর উপরে চাপ বাড়িয়ে দেওয়াই বা হল কেন?''
প্রশ্ন ছুড়ে দেন সমীর চৌধুরী। গোটা ময়দান এই প্রশ্নেরই জবাব খুঁজছে। ম্যাচ হারার পরে অস্কার ব্রুজোঁ কারওর নাম না নিয়ে বলেছিলেন, ''কোচিং স্টাফরা আমাকে গোলকিপার পরিবর্তন করার কথা বলেছিলেন। আমি তাঁদের অনুসরণ করেছি।''
সমীর চৌধুরী বলছেন, ''অস্কার ব্রুজোঁ ভাল কোচ। বাংলাদেশে সাফল্য পেয়েছেন। সেই তিনি এমন কথা বলবেন এটা প্রত্যাশিত নয়। আপনি হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট। আপনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সাপোর্ট স্টাফের কথায় খেলোয়াড় বদলেছি এমন কথা বলা উচিতই হয়নি ওঁর।''
চিরিচ মিলোভানকে শ্রদ্ধা করেন। এশিয়ান ক্লাব কাপে শ্রীলঙ্কায় গিয়ে গোল করার পরে পিকে ব্যানার্জির কথা স্মরণ করে বলেন, ''প্রদীপদা বলেছিলেন, সমীর আন্তর্জাতিক মানের গোল করলি।'' সেই তিনিই আবার বলছেন, ''বিদেশি কোচদের নিয়ে আসা আমার পছন্দ নয়। ওঁরা আবেগ বোঝে না।'' 
 
 প্রাক্তন ফুটবলারের মতে, টাইব্রেকারে ভাগ্যের দরকার। সেদিন দেবজিৎ দুটো শট বাঁচিয়ে দিলেই সেভজিৎ হয়ে যেতেন। কিন্তু ভাগ্য সেদিন সমীরবাবুর জামাতার সঙ্গে ছিল না। 

নিজের খেলোয়াড়জীবনের উদাহরণ তুলে সমীরবাবু বলেন, ''পেনাল্টি ভাগ্যের ব্যাপার। মনে পড়ে যাচ্ছে ছিয়াশি সালের লিগের রেলওয়ে এফসি-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের কথা। আমাদের সঙ্গে মোহনবাগানের এক পয়েন্টের পার্থক্য ছিল। হেরে গেলে বা ড্র করলেই মোহনবাগান চ্যাম্পিয়ন। আমি ক্যাপ্টেন ছিলাম। পেনাল্টি পেলাম। আমি মনাদাকে (মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য) বললাম, তুমি মারো। মনাদা বললেন, তুই ক্যাপ্টেন, তুই-ই মার। আমি গোল করেছিলাম। তার পরে সমর্থকদের পিঠে চেপে টেন্টে পৌঁছেছিলাম।''
পিকে-র বিখ্যাত ভোকাল টনিকের কথা ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। লিও মেসির কাছ থেকে সেরাটা বের করে নিয়েছিলেন পেপ গুয়ার্দিওলা। সমীর চৌধুরী বলছেন, ''প্লেয়ারের কাছ থেকে সেরাটা আদায় করে নেওয়াই কোচের কাজ। সেদিন দেবজিৎকে উনি বলতেই পারতেন, যাও গিয়ে দেখিয়ে দাও সবাইকে। কিন্তু সবার সামনে প্রশ্ন করে উল্টে চাপ বাড়িয়ে দিলেন কোচ। আমার এটা ভাল লাগেনি।'' শিল্ড ফাইনালে রবসনের শট প্রায় থামিয়েই দিয়েছিলেন। পেত্রাতোসের শট তাঁর হাত স্পর্শ করে জালে জড়িয়ে যায়।
সামনেই সুপার কাপ। মাণ্ডবী তীরে একই গ্রুপে ইস্ট-মোহন। গ্রুপ পর্বেই ফের দেখা যাবে দুই প্রধানের লড়াই। ফুটবলজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সমীর চৌধুরীর পরামর্শ, ''যা হয়ে গিয়েছে, তা নিয়ে না ভেবে সামনের দিকেই তাকাক ইস্টবেঙ্গল। সুপার কাপের জন্য প্রস্তুতি নিক। জিতে ফিরুক।'' একটা জয়ই সব ভুলিয়ে দিতে পারে নিমেষে। অস্কার ব্রুজোঁও নিশ্চয় তা জানেন।
আরও পড়ুন: বিরাট-রোহিতের পাশে প্রাক্তন কোচ, ভিন্ন মত অজি কিংবদন্তির
